Skip to main content

ইন্দ্র ও ইন্দ্রধ্বজ : বাংলার বিস্মৃত মহোৎসব

সারা ভারতবর্ষে কোথাও ইন্দ্রপূজা আজও পালিত হয়—শুনিয়াছ কি? হ্যাঁ, বাংলার মাটিতেও ইহা আজো জীবন্ত। বিস্মিত হইলে তো?


ইতিহাসপুস্তকে তোমরা পড়িয়াছ—ইন্দ্র আদিবৈদিক দেবতা, আর বাঙালি নাকি অনার্য জাতি। তাই বইয়ের বাণী ও জীবনের সত্য প্রায়ই পরস্পরের বিরোধী হয়। যে ভূখণ্ডে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ দশানন রাবণকে আদিবাসী বলিয়া চিত্রিত করা হয়, সেইখানে এ-বিচিত্রতা আর কী নতুন?

আস, তবে বাঙালির এই আদি উৎসবের মাহাত্ম্য বুঝিয়া লই।

দেবরাজ ইন্দ্র, দিকপালরূপে নিত্য পূজিত, কিন্তু গ্রামবাংলার হৃদয়ে তিনি কৃষির রক্ষাকর্তা, বৃষ্টির অধিপতি। উহার কৃপাতেই ধান্যশ্যামলা হইয়া ওঠে ভূমি।

এই উৎসব পালিত হয় করম একাদশীর পরদিন, দ্বাদশীর শুভ তিথিতে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ‘পূজাপার্বণ’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন—প্রাচীনকালে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল নবমী হইতে তিন মাস তিন তিথি পর, অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশীতেই সূর্যের দক্ষিণায়ন আরম্ভ হইত। ঐ দিবসের নাম ছিল ‘বামন দ্বাদশী’। সেদিন রাজারা প্রজাসহ ধ্বজ রোপণ করিতেন, পতাকা বাঁধিতেন। ধ্বজের ছায়া দেখিয়া দক্ষিণায়নের কাল নিরূপণ হইত, পতাকার দোলন দেখিয়া বায়ুর গতিপথ বোঝা যাইত।

ইন্দ্রপূজার প্রাচীনত্ব অতলস্পর্শী। নীহাররঞ্জন রায় লিখিয়াছেন, চন্দ্রকেতুগড় হইতে ধর্মপাল-নারায়ণ পালের লিপি, সর্বত্রই ইন্দ্রবিগ্রহ ও পৌরাণিক কাহিনি জাগ্রত। তিনি বলেন, একাদশ শতকেরও পূর্বে এ উৎসব ছিল। গোবর্ধন আচার্যের ‘আর্য-সপ্তশতী’ এবং জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’-এ ‘শত্রুধ্বজ পূজা’র উল্লেখ ইহার সাক্ষ্য।


জন আরউইন বলিয়াছেন—ইন্দ্র বহনযোগ্য যষ্টি রাজা বসুকে দান করিয়াছিলেন। তিনি ও পরবর্তী রাজারা বার্ষিক পূজায় ইহা উত্তোলন করিবেন, ইহাই ছিল বিধান। ঋগ্বৈদিক যুগে প্রচলিত এই আচার, আজো ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার দ্যুতিময় দৃষ্টান্ত।

(John Irwin: Asokan Pillars, Part IV – Symbolism, Burlington Magazine, Vol. CXVIII, 1976)

শাস্ত্রও ইহার সাক্ষ্য প্রদান করে। দেবীপুরাণ-এ আছে—শিব হইতে বিষ্ণু কেতু লাভ করেন; বিষ্ণু হইতে ইন্দ্র, ইন্দ্র হইতে চন্দ্র, চন্দ্র হইতে দক্ষ। দক্ষরাজের পর হইতে সকল রাজাই ইন্দ্রধ্বজ উত্তোলন করিতে থাকেন।

গ্রামবাংলার আদি জনপদে বৃষ্টিদেবতার আরাধনা ছিল এক মহোৎসব। মানভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের ভূমিখণ্ডে ইহা একদা জাঁকজমকের সহিত পালিত হইত। রাঢ়বঙ্গের অগণিত গ্রামে আজও কালীতলা, ষষ্ঠীতলার ন্যায় ইন্দ্রতলার উপস্থিতি সেই প্রাচীন স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করিতেছে। মুর্শিদাবাদের কান্দি মহকুমার শ্রীহট্ট ইন্দ্রতলা, কান্দির জেমো ইন্দ্রতলা প্রভৃতি স্থানে আজো দেবরাজ ইন্দ্রের থান বিরাজমান, যেখানে লোকবিশ্বাসে বৃষ্টির করুণা ও কৃষির সমৃদ্ধি সংরক্ষিত।

তবু, অদ্ভুতভাবে আজ কেহ আমায় বা আপনাকে ইহা উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানায় নাই। সকলেই navi diwas-উদযাপনে ব্যস্ত। অথচ এ উৎসবই আমাদের আদি, বৈদিক, স্বজাতীয় ঐতিহ্যের দীপ্ত প্রমাণ।

Comments

Popular posts from this blog

বঙ্গে রামনবমী

প্রায় কিছু বৎসর পূর্ব হইতে দেখছি যীশু-পূজা, রমজান, ঈদ পালন করা কলকাতার বাবুগণ রামনবমী পালন হতে দেখিলে ত্রাহি ত্রাহি রব তোলেন। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে—রামের প্রভাব বাড়িলে তাঁদের বেল্লাপনা বন্ধ হইবে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির উপর আরব ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন বন্ধ হবে। কিন্তু সরাসরি ভারত সম্রাটের বিরোধিতা করিলে, পাছে বাঙালি ক্ষেপে গিয়ে জুতোপেটা করে, তাই ভয়ে ভয়ে এখন বলছে—"রামনবমী বাংলার সংস্কৃতিতে ছিল না, বাঙালি এই অবাঙালি আগ্রাসন মানবে না…" ইত্যাদি ইত্যাদি। কেহ কেহ আবার হুতুম পেঁচার নকশা হইতে দেখাইতেছেন রামলীলাকে খোট্টা উৎসব বলে। তাঁরা লিখছেন—বাঙালির রাম বলতে রামমোহন ও রামকৃষ্ণ। এদের মতো নিরেট মাথামোটা বিশ্বভ্রমণ করলেও অল্পই মিলবে। রামমোহন নিজ পত্রের অন্তে পরিচয় হিসাবে নিজেকে "শ্রী রামের দাস" হিসেবে উল্লেখ করেন। আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কুলদেবতা তো স্বয়ং রঘুবীর। এসব নয়, পরে আলোচনা করা যাবে। আগেও বহুবার বলেছি—কলকাতার বাবুদের বাংলা সম্পর্কে ধারণা কম। তাই Xmas বাঙালির উৎসব আর রামনবমী অবাঙালি হয়ে যায়! মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় বহু ৩০০-৪০০ বছর পুরোনো রাম মন্দির( আরও জানতে )দে...

বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য: আর্য-অনার্য বিতর্কের ঐতিহাসিক সত্য

প্রাচীন শাস্ত্র ও ঐতিহাসিক দলিলে বারবার "বঙ্গ" শব্দের উল্লেখ থাকলেও "বাংলা" শব্দটি অনুপস্থিত। নাম নিয়ে অনেকের ধারণা থাকতে পারে, "নামে কী বা আসে যায়?" কিন্তু এখানে নামের গুরুত্ব ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, প্রাচীন বঙ্গ আজকের সম্পূর্ণ বাংলা অঞ্চলকে নির্দেশ করে না। মহাভারতের যুগে তমলুক, পুণ্ড্র এবং অঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে বঙ্গ একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা ছিল, যা আজকের বাংলার সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত নয়। দাবির বিশ্লেষণ: বঙ্গ কি অনার্য ভূমি? অনেকে দাবি করেন যে, বাঙালায় বাইরের কেউ এলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো, কারণ বঙ্গ অনার্য ভূমি। এই তথ্য বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেই বিভ্রান্তি রয়েছে।  "কারণ বঙ্গ অনার্যভূমি" এই উল্লেখ নেই। ওটা বামপন্থীদের কল্পনা। বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে যা বলা হয়েছে, তা ব্রাহ্মণদের জন্য প্রযোজ্য: [শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ বলেছি তার কারণ হলো, পরবর্তীতে অনেক রাজা বঙ্গের রাজাদের সাথে যুদ্ধে, বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এসেছিলেন। তারা প্রা...

আর্যাবর্তের প্রকৃত সংজ্ঞা: শাস্ত্র কি বলে?

একসময় যে বাংলায় রঘুনাথ স্মার্তি ও মধুসূদন সরস্বতীর মতো শাস্ত্রজ্ঞানীরা বিরাজমান ছিলেন, সেই বাংলায় আজ হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা মিথ্যাচার চলছে। এটা চলতে পারার মূলত দুটো কারণ রয়েছে। এক, গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরা সামাজিক মাধ্যম চালাতে জানেন না। দুই, বিগত ৪০ বছরের নাস্তিক শাসন হিন্দুদের থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ কেড়ে নিয়ে সেগুলো চরম হিন্দুবিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছে। তবুও, পরম্পরাগত হিন্দুরা আবার নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। আজকের আলোচনার বিষয় আর্যাবর্তের সীমারেখা। নানা সময়ে বিতর্কে দেখেছি, এই আর্যাবর্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তথাকথিত ডানপন্থী হিন্দুরা হয় অস্বস্তিতে পড়েন, নয়তো এড়িয়ে যান। স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না। দেখুন, শাস্ত্রে আর্যবর্তের তিন প্রকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমি একে একে বলছি: ১.মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাইশতম শ্লোকটি দেখুন।এই শ্লোক অনুযায়ী, আজকের পুরো ভারতই আর্যাবর্ত। শুধু তাই নয়, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রের (1.9) প্রথম অধ্যায়ে মনুস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে হিমালয়ের দক্ষিণ পর্যন্ত আর্যাবর্ত প্রসারিত।(বাংলা হিমালয়ের দক...