একসময় যে বাংলায় রঘুনাথ স্মার্তি ও মধুসূদন সরস্বতীর মতো শাস্ত্রজ্ঞানীরা বিরাজমান ছিলেন, সেই বাংলায় আজ হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা মিথ্যাচার চলছে।
এটা চলতে পারার মূলত দুটো কারণ রয়েছে। এক, গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরা সামাজিক মাধ্যম চালাতে জানেন না। দুই, বিগত ৪০ বছরের নাস্তিক শাসন হিন্দুদের থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ কেড়ে নিয়ে সেগুলো চরম হিন্দুবিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছে।
তবুও, পরম্পরাগত হিন্দুরা আবার নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে।
আজকের আলোচনার বিষয় আর্যাবর্তের সীমারেখা। নানা সময়ে বিতর্কে দেখেছি, এই আর্যাবর্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তথাকথিত ডানপন্থী হিন্দুরা হয় অস্বস্তিতে পড়েন, নয়তো এড়িয়ে যান। স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না।
দেখুন, শাস্ত্রে আর্যবর্তের তিন প্রকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
আমি একে একে বলছি:
১.মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাইশতম শ্লোকটি দেখুন।এই শ্লোক অনুযায়ী, আজকের পুরো ভারতই আর্যাবর্ত।
শুধু তাই নয়, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রের (1.9) প্রথম অধ্যায়ে মনুস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে হিমালয়ের দক্ষিণ পর্যন্ত আর্যাবর্ত প্রসারিত।(বাংলা হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত।)
২. বৌধায়ন ধর্মসূত্রে(1.1.2.12) বলা হয়েছে, যে ভূমিতে কৃষ্ণসার হরিণ ঘোরাফেরা করে, তাই আর্যাবর্ত।মনুস্মৃতি(2.22) ও বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রেও(1.15) একই কথা বলা হয়েছে।
এই সংজ্ঞা অনুযায়ীও ভারতের প্রায় সব রাজ্য আর্যবর্তের মধ্যে পড়ে।
তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি—মনু বলেছেন, "কৃষ্ণসার মৃগ যেখানে চারণ করে, তা যজ্ঞভূমি।"
বাঙালিদের উদ্দেশে বলা যায়, ১৮৯১ সালের ব্রিটিশ সার্ভে অনুযায়ী মেদিনীপুর অঞ্চলে কৃষ্ণসার মৃগ পাওয়া যেত। অধিকাংশ দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যে কৃষ্ণসার মৃগ রয়েছে, এই কারণেই সেগুলিও আর্যাবর্তের অংশ।
৩.বিষ্ণু স্মৃতির ৮৪তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, যে ভূমিতে চার বর্ণের মানুষ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) বসবাস করে, তাই আর্যবর্ত।এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, যেখানেই হিন্দু সভ্যতা থাকবে, তাই আর্যভূমি।
শ্রুতি ও স্মৃতি শাস্ত্র মেনে চলা লোকেরাই আর্য। তাই রামায়ণে রাবণকেও মন্দোদরী "আর্যপুত্র" বলে উল্লেখ করেছেন। (আর্য সভ্যতায় স্ত্রী তার স্বামীকে "আর্যপুত্র" বলে সম্বোধন করতেন।)
নানা শাস্ত্রে আর্যাবর্তের অনেক সীমারেখা উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু যজুর্বেদ বলছে, মনু যা বলেছেন তা-ই ভেষজ, এবং মনুস্মৃতি স্মৃতি-শ্রেষ্ঠ; তাই মনুর সংজ্ঞা মেনে চলা যেতে পারে। (চতুর্বেদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত না হলে মনুস্মৃতির বচন খণ্ডন করা সম্ভব নয়।) আর্যাবর্তের সংজ্ঞা নিয়ে যত শাস্ত্রই পড়া হোক না কেন, তাতে ইরান কিংবা রাশিয়ার কোনো উল্লেখ নেই। বামপন্থীদের প্রোপাগান্ডা যে "শুধু উত্তর ভারতই আর্যবর্ত", "আর্যরা বাইরে থেকে এসেছে" তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।উপরে আর্যবর্তের সম্পূর্ণ সংজ্ঞা দেওয়া হলো, যা থেকে পরিষ্কার যে আজকের পুরো ভারতই আর্যবর্ত।
Comments
Post a Comment