Skip to main content

বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য: আর্য-অনার্য বিতর্কের ঐতিহাসিক সত্য

প্রাচীন শাস্ত্র ও ঐতিহাসিক দলিলে বারবার "বঙ্গ" শব্দের উল্লেখ থাকলেও "বাংলা" শব্দটি অনুপস্থিত। নাম নিয়ে অনেকের ধারণা থাকতে পারে, "নামে কী বা আসে যায়?" কিন্তু এখানে নামের গুরুত্ব ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, প্রাচীন বঙ্গ আজকের সম্পূর্ণ বাংলা অঞ্চলকে নির্দেশ করে না।

মহাভারতের যুগে তমলুক, পুণ্ড্র এবং অঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে বঙ্গ একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা ছিল, যা আজকের বাংলার সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত নয়।

দাবির বিশ্লেষণ: বঙ্গ কি অনার্য ভূমি?

অনেকে দাবি করেন যে, বাঙালায় বাইরের কেউ এলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো, কারণ বঙ্গ অনার্য ভূমি। এই তথ্য বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেই বিভ্রান্তি রয়েছে। "কারণ বঙ্গ অনার্যভূমি" এই উল্লেখ নেই। ওটা বামপন্থীদের কল্পনা।

বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে যা বলা হয়েছে, তা ব্রাহ্মণদের জন্য প্রযোজ্য:[শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ বলেছি তার কারণ হলো, পরবর্তীতে অনেক রাজা বঙ্গের রাজাদের সাথে যুদ্ধে, বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এসেছিলেন। তারা প্রায়শ্চিত্ত করেননি।]

> “ব্রাহ্মণরা যদি তীর্থ ব্যতীত অন্য কোনো কারণে বঙ্গে প্রবেশ করতেন, তবে তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো।”

তাছাড়া, যদি বঙ্গকে অনার্য ভূমি বলা হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে—অনার্য ভূমিতে তীর্থ কীভাবে সম্ভব? মহাভারতে অর্জুন নিজে বঙ্গভূমিতে তীর্থ করেছেন। এটি স্পষ্ট করে যে, বঙ্গকে অনার্য ভূমি বলা সঠিক নয়।

কিন্তু একই তালিকায় পাঞ্জাবের নামও রয়েছে, যা বামপন্থী ঐতিহাসিকদের মতে আর্যভূমি। 

মনুস্মৃতির দ্বিতীয় [2.22] অধ্যায়ে বঙ্গকে আর্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। মহাভারতে বঙ্গীয় বীরদের প্রশংসা করা হয়েছে। মহাভারতের সভা পর্বে বঙ্গের রাজাদের "বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয়" এবং "ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ" বলা হয়েছে।


মহাভারতে বলা হয়েছে, ঋষি দীর্ঘতমসের পুত্রের নাম অনুসারে বঙ্গ নামকরণ করা হয়েছে। এটি স্পষ্টতই আর্য ঋষি ও সংস্কৃতির সঙ্গে বঙ্গের গভীর সম্পর্ক প্রমাণ করে।

ঋগ্বেদের অংশ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ[যা কিনা বৌদ্ধধর্ম সূত্রের চেয়ে অনেক প্রাচীন।] অনুযায়ী, পুণ্ড্রবাসীরা ঋষি বিশ্বামিত্রের পুত্র। এটি প্রমাণ করে যে, বঙ্গ এবং পুণ্ড্র অঞ্চলের মানুষ আর্য ঋষিদের উত্তরসূরি।

মহাভারতে বর্ণিত বঙ্গীয় বীরদের বীরত্ব, রাজসুয় যজ্ঞে তাদের অংশগ্রহণ এবং স্বয়ম্বর সভায় তাদের উপস্থিতি বঙ্গের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী। কর্ণ পর্বে কর্ণ বলেছেন যে, পুণ্ড্রবাসীরা সনাতন ধর্ম জানে ও মেনে চলে।

প্রাচীন বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলো—অঙ্গ, পুণ্ড্র, গৌড়, তাম্রলিপ্তি—আজকের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের ভিত্তি স্থাপন করেছে। বাংলা ভাষা একটি আর্য ভাষা।

সনাতন শাস্ত্রে কোথাও বাঙালিকে অনার্য বলা হয়নি। বরং বঙ্গের ক্ষত্রিয় বংশধরদের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, প্রাচীন বঙ্গ আর্য সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বঙ্গবাসী আর্য ঋষিদের উত্তরসূরি এবং সনাতন ধর্মের গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক।

বাঙালিকে অনার্য প্রমাণ করতে গিয়ে দেখা যায়, ইতিহাসের বাস্তবতা ভিন্ন। বঙ্গের ইতিহাস আর্য সংস্কৃতি, ক্ষত্রিয় গৌরব এবং সনাতন ঐতিহ্যের অঙ্গীভূত।

Read:Mahabharata and Bengali

Comments

Popular posts from this blog

বঙ্গে রামনবমী

প্রায় কিছু বৎসর পূর্ব হইতে দেখছি যীশু-পূজা, রমজান, ঈদ পালন করা কলকাতার বাবুগণ রামনবমী পালন হতে দেখিলে ত্রাহি ত্রাহি রব তোলেন। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে—রামের প্রভাব বাড়িলে তাঁদের বেল্লাপনা বন্ধ হইবে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির উপর আরব ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন বন্ধ হবে। কিন্তু সরাসরি ভারত সম্রাটের বিরোধিতা করিলে, পাছে বাঙালি ক্ষেপে গিয়ে জুতোপেটা করে, তাই ভয়ে ভয়ে এখন বলছে—"রামনবমী বাংলার সংস্কৃতিতে ছিল না, বাঙালি এই অবাঙালি আগ্রাসন মানবে না…" ইত্যাদি ইত্যাদি। কেহ কেহ আবার হুতুম পেঁচার নকশা হইতে দেখাইতেছেন রামলীলাকে খোট্টা উৎসব বলে। তাঁরা লিখছেন—বাঙালির রাম বলতে রামমোহন ও রামকৃষ্ণ। এদের মতো নিরেট মাথামোটা বিশ্বভ্রমণ করলেও অল্পই মিলবে। রামমোহন নিজ পত্রের অন্তে পরিচয় হিসাবে নিজেকে "শ্রী রামের দাস" হিসেবে উল্লেখ করেন। আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কুলদেবতা তো স্বয়ং রঘুবীর। এসব নয়, পরে আলোচনা করা যাবে। আগেও বহুবার বলেছি—কলকাতার বাবুদের বাংলা সম্পর্কে ধারণা কম। তাই Xmas বাঙালির উৎসব আর রামনবমী অবাঙালি হয়ে যায়! মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় বহু ৩০০-৪০০ বছর পুরোনো রাম মন্দির( আরও জানতে )দে...

আর্যাবর্তের প্রকৃত সংজ্ঞা: শাস্ত্র কি বলে?

একসময় যে বাংলায় রঘুনাথ স্মার্তি ও মধুসূদন সরস্বতীর মতো শাস্ত্রজ্ঞানীরা বিরাজমান ছিলেন, সেই বাংলায় আজ হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা মিথ্যাচার চলছে। এটা চলতে পারার মূলত দুটো কারণ রয়েছে। এক, গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরা সামাজিক মাধ্যম চালাতে জানেন না। দুই, বিগত ৪০ বছরের নাস্তিক শাসন হিন্দুদের থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ কেড়ে নিয়ে সেগুলো চরম হিন্দুবিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছে। তবুও, পরম্পরাগত হিন্দুরা আবার নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। আজকের আলোচনার বিষয় আর্যাবর্তের সীমারেখা। নানা সময়ে বিতর্কে দেখেছি, এই আর্যাবর্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তথাকথিত ডানপন্থী হিন্দুরা হয় অস্বস্তিতে পড়েন, নয়তো এড়িয়ে যান। স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না। দেখুন, শাস্ত্রে আর্যবর্তের তিন প্রকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমি একে একে বলছি: ১.মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাইশতম শ্লোকটি দেখুন।এই শ্লোক অনুযায়ী, আজকের পুরো ভারতই আর্যাবর্ত। শুধু তাই নয়, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রের (1.9) প্রথম অধ্যায়ে মনুস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে হিমালয়ের দক্ষিণ পর্যন্ত আর্যাবর্ত প্রসারিত।(বাংলা হিমালয়ের দক...