Skip to main content

বঙ্গে কালিকা পূজা: লোকাচার নাকি শাস্ত্রাচার?

বঙ্গেশ্বরী কালিকা আরাধনা বৈদিক— এক প্রমাণভিত্তিক প্রতিপাদ্য

বঙ্গে তথা ভারতবর্ষে বঙ্গেশ্বরী দেবী কালিকার আরাধনা অতিপ্রাচীন, সুসংহত ও ধর্মমূলে প্রতিষ্ঠিত। তথাপি বর্তমানে কতিপয় তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সদ্যপ্রস্ফুটিত এনজিও সদৃশ পরম্পরাবিচ্ছিন্ন সংগঠনসমূহ কৌশলে কালিকা আরাধনাকে “অবৈদিক” বলিয়া প্রচার করিবার অপচেষ্টা করিতেছে। উহাদের যুক্তি এইরূপ— “প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে দেবী কালিকার উল্লেখ নাই; ইহা পরবর্তীকালের পৌরাণিক রচনা।”

কিন্তু এই বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।পুরাণের উল্লেখ স্বয়ং বৈদিক সাহিত্যে বর্তমান। উদাহরণস্বরূপ, শতপথ ব্রাহ্মণ-এ পুরাণ শব্দটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। মহাভারতের স্বর্গারোহণ পর্বে (৫.৪৫) স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে — “আঠারোটি পুরাণ” একটি স্বীকৃত, শাস্ত্রসম্মত বিভাগ। অতএব, পুরাণ বেদ-বিরোধী নয় — বরং বেদ থেকেই পুরাণের বীজ।

ইহাদের উদ্দেশ্য হইল সাধারণ হিন্দুকে বেদ ও শাস্ত্রতত্ত্ব হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ধর্মচ্যুত করিয়া তোলা। কারণ, অধিকাংশ হিন্দু ধর্মতত্ত্ব পাঠ করেন না; বরং পূজা-পার্বণ ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মে অবিচল থাকেন। অতএব, ইহারাই কালিকা, শ্রীকৃষ্ণ, মহাদেব প্রভৃতি বহুপূজিত ব্রহ্মস্বরূপ দেবদেবীদের অবৈদিক বলিয়া মিথ্যাচার করেন। কিন্তু বঙ্গীয় বিদ্বান ব্রাহ্মণগণের সম্মুখে এই মিথ্যাবাদ বলিবার সাহস উহারা রাখে না।

বঙ্গদেশে দেবীকে মৎস্য নিবেদন একটি প্রচলিত রীতি। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীবর্গ এই প্রসঙ্গে বলেন— “বেদে বিগ্রহপূজা বা বলি নাই, মাছ নিবেদন অবৈদিক।”

এই যুক্তির খণ্ডন নিম্নরূপ—

বঙ্গে যেরূপে কালিকা পূজা সম্পাদিত হয়, তাহা আদৌ অবৈদিক নহে। এই কথা প্রমাণার্থে নিম্নলিখিত বিষয়াদি উদাহরণস্বরূপ প্রদান করা যাইতেছে—

মনুস্মৃতি ৫।১৬

“পাঠীন ও রোহিত জাতীয় মাছ দেবতা ও পিতৃপূজায় উপযোগী; রাজীব, সিংহতুণ্ড, ও শল্কযুক্ত মৎস্য যেকোনো সময়ে ভক্ষণযোগ্য।”

(পাঠীনরোহিতৌ আদ্যৌ নিযুক্তৌ হব্যকব্যয়োঃ।

রাজীবান্ সিংহতুণ্ডাশ্চ সশল্কাশ্চৈব সর্বশঃ॥)

অতএব, শল্কযুক্ত মৎস্য (যেমন—ইলিশ, রুই প্রভৃতি) নিবেদন সম্পূর্ণরূপে বৈদিক অনুমোদিত। এই কারণেই পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ উভয় প্রান্তে কালিকা দেবীর পূজায় ইহা প্রথিত।

মনুস্মৃতি ৩।৮৯

“উচ্চীর্ষে লক্ষ্মীদেবীর, পাদদেশে ভদ্রকালীর, আর বাস্তুমধ্যে ব্রহ্মা ও বাস্তুপতির উদ্দেশ্যে বলি প্রদান করিবে।”

অতএব, ভদ্রকালীর পূজা তথা বলি প্রদান মনুস্মৃতিতে স্পষ্টরূপে উল্লিখিত। এই প্রথা বঙ্গদেশে বহুল প্রচলিত ও বৈদিক স্বীকৃত।

বঙ্গে একটি প্রচলিত রীতি হইল— দেববিগ্রহের ছায়া লঙ্ঘন করিবে না। এই রীতির উৎস মনুস্মৃতিতেই নিহিত।

মনুস্মৃতি ৪।১৩০

“দেবতা, গুরু, রাজা, স্নাতক, আচার্য, দীক্ষিত ব্যক্তির ছায়া ইচ্ছাকৃতভাবে মাড়াইবে না।”

(দেবতানাং গুরো রাজ্ঞঃ স্নাতকাচার্যয়োস্তথা।

নাক্রামেত্ কামতশ্চায়াং বভ্রুণো দীক্ষিতস্য চ॥)

ইহা হইতেই প্রতিপন্ন হয়— বিগ্রহপূজা ও তদনুগত আচরণ বৈদিক কালে সুপ্রচলিত ও মর্যাদাসম্পন্ন ছিল।
বেদে নির্দেশিত হইয়াছে যাহা মনু বিধান করিয়াছেন, তাহাই পাথেয় স্বরূপ। তদ্ব্যতীত, বঙ্গীয় লোকাচারসঙ্গত যজ্ঞ-বিধান, যথা—বাস্তুপূজা প্রভৃতি, এই শ্লোকে প্রতিফলিত হইয়াছে।
হ্যাঁ মহাশয়, আপনি যথার্থই উপলব্ধি করিয়াছেন—বঙ্গে কালীপূজা মনুস্মৃতির নির্দেশ অনুসারে সম্পাদিত হয়। যাহাদের মনুস্মৃতি সম্বন্ধে আপত্তি বিদ্যমান, তাহারা পূজায় অংশগ্রহণ করিবেন কি না, তাহা বিবেচনা করিয়া দেখিবেন।

কাঠক গৃহ্যসূত্র ১৯।৭ (২।৩)

“অগ্নি, সোম, বরুণ, মিত্র, ইন্দ্র, স্কন্দ, রুদ্র, ভগ, ভগনক্ষত্র, কালী, ষষ্ঠী, ভদ্রকালী, পূষণ, ত্বষ্টা, মহিষিকা প্রভৃতি দেবতাকে গন্ধাহুতি দিয়া পূজা করিবে।”

(অগ্নিঃ সোমঃ বরুণশ্চ মিত্রঃ স্কন্দশ্চ রুদ্রকঃ।

ভগো নক্ষত্রভগশ্চ কালী ষষ্ঠী চ ভদ্রকালী॥

পূষা ত্বষ্টা চ মহিষীকা, গন্ধাহুতিভির্যজেৎ॥)


ইহা হইতে প্রতিপন্ন হয়— গৃহ্যসূত্রেই (স্বয়ং বেদাঙ্গে)দেবী কালিকা, ভদ্রকালী, ষষ্ঠীর উপাসনার প্রমাণ রহিয়াছে।

---বঙ্গদেশে কালিকা পূজা কেবলমাত্র লোকাচার নহে— ইহা শাস্ত্রসম্মত, স্মার্ত ও বৈদিক পদ্ধতিতে প্রবর্তিত। যাহারা ইহাকে “অবৈদিক” বলিয়া প্রচার করেন, তাহারা শাস্ত্রজ্ঞ নন, ধর্মপ্রতারণায় লিপ্ত। বঙ্গীয় হিন্দুসমাজ মনুস্মৃতি ও গৃহ্যসূত্র মেনে কালিকার পূজা করিয়া যে ঐতিহ্য বজায় রাখিয়াছে, তাহা হিন্দু ধর্মের এক গৌরবময় অধ্যায়।

Comments

  1. যজুর্বেদ এর প্রথম মন্ত্রে সমস্ত পশুদের রক্ষা করার কথা বলছে। আর মানুষ এর মধ্যে অনেক লোকই প্রক্ষিপ্ত রয়েছে সেখানে আপনি কি বলবেন? তাছাড়াও কুরআনের কথা আপনি বলছেন কোরআনের বেশিরভাগ অংশই বেদ বিরুদ্ধে। এরকম ক্ষেত্রে মনুস্মৃতিতে বলা আছে যে স্মৃতি শ্রুতি আর পুরানের মধ্যে বিরোধ ঘটলে স্মৃতির প্রাধান্য সবার উপরে তারপর শ্রুতি তারপর পুরান।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বঙ্গে রামনবমী

প্রায় কিছু বৎসর পূর্ব হইতে দেখছি যীশু-পূজা, রমজান, ঈদ পালন করা কলকাতার বাবুগণ রামনবমী পালন হতে দেখিলে ত্রাহি ত্রাহি রব তোলেন। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে—রামের প্রভাব বাড়িলে তাঁদের বেল্লাপনা বন্ধ হইবে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির উপর আরব ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন বন্ধ হবে। কিন্তু সরাসরি ভারত সম্রাটের বিরোধিতা করিলে, পাছে বাঙালি ক্ষেপে গিয়ে জুতোপেটা করে, তাই ভয়ে ভয়ে এখন বলছে—"রামনবমী বাংলার সংস্কৃতিতে ছিল না, বাঙালি এই অবাঙালি আগ্রাসন মানবে না…" ইত্যাদি ইত্যাদি। কেহ কেহ আবার হুতুম পেঁচার নকশা হইতে দেখাইতেছেন রামলীলাকে খোট্টা উৎসব বলে। তাঁরা লিখছেন—বাঙালির রাম বলতে রামমোহন ও রামকৃষ্ণ। এদের মতো নিরেট মাথামোটা বিশ্বভ্রমণ করলেও অল্পই মিলবে। রামমোহন নিজ পত্রের অন্তে পরিচয় হিসাবে নিজেকে "শ্রী রামের দাস" হিসেবে উল্লেখ করেন। আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কুলদেবতা তো স্বয়ং রঘুবীর। এসব নয়, পরে আলোচনা করা যাবে। আগেও বহুবার বলেছি—কলকাতার বাবুদের বাংলা সম্পর্কে ধারণা কম। তাই Xmas বাঙালির উৎসব আর রামনবমী অবাঙালি হয়ে যায়! মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় বহু ৩০০-৪০০ বছর পুরোনো রাম মন্দির( আরও জানতে )দে...

বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য: আর্য-অনার্য বিতর্কের ঐতিহাসিক সত্য

প্রাচীন শাস্ত্র ও ঐতিহাসিক দলিলে বারবার "বঙ্গ" শব্দের উল্লেখ থাকলেও "বাংলা" শব্দটি অনুপস্থিত। নাম নিয়ে অনেকের ধারণা থাকতে পারে, "নামে কী বা আসে যায়?" কিন্তু এখানে নামের গুরুত্ব ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, প্রাচীন বঙ্গ আজকের সম্পূর্ণ বাংলা অঞ্চলকে নির্দেশ করে না। মহাভারতের যুগে তমলুক, পুণ্ড্র এবং অঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে বঙ্গ একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা ছিল, যা আজকের বাংলার সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত নয়। দাবির বিশ্লেষণ: বঙ্গ কি অনার্য ভূমি? অনেকে দাবি করেন যে, বাঙালায় বাইরের কেউ এলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো, কারণ বঙ্গ অনার্য ভূমি। এই তথ্য বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেই বিভ্রান্তি রয়েছে।  "কারণ বঙ্গ অনার্যভূমি" এই উল্লেখ নেই। ওটা বামপন্থীদের কল্পনা। বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে যা বলা হয়েছে, তা ব্রাহ্মণদের জন্য প্রযোজ্য: [শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ বলেছি তার কারণ হলো, পরবর্তীতে অনেক রাজা বঙ্গের রাজাদের সাথে যুদ্ধে, বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এসেছিলেন। তারা প্রা...

আর্যাবর্তের প্রকৃত সংজ্ঞা: শাস্ত্র কি বলে?

একসময় যে বাংলায় রঘুনাথ স্মার্তি ও মধুসূদন সরস্বতীর মতো শাস্ত্রজ্ঞানীরা বিরাজমান ছিলেন, সেই বাংলায় আজ হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা মিথ্যাচার চলছে। এটা চলতে পারার মূলত দুটো কারণ রয়েছে। এক, গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরা সামাজিক মাধ্যম চালাতে জানেন না। দুই, বিগত ৪০ বছরের নাস্তিক শাসন হিন্দুদের থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ কেড়ে নিয়ে সেগুলো চরম হিন্দুবিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছে। তবুও, পরম্পরাগত হিন্দুরা আবার নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। আজকের আলোচনার বিষয় আর্যাবর্তের সীমারেখা। নানা সময়ে বিতর্কে দেখেছি, এই আর্যাবর্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তথাকথিত ডানপন্থী হিন্দুরা হয় অস্বস্তিতে পড়েন, নয়তো এড়িয়ে যান। স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না। দেখুন, শাস্ত্রে আর্যবর্তের তিন প্রকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমি একে একে বলছি: ১.মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাইশতম শ্লোকটি দেখুন।এই শ্লোক অনুযায়ী, আজকের পুরো ভারতই আর্যাবর্ত। শুধু তাই নয়, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রের (1.9) প্রথম অধ্যায়ে মনুস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে হিমালয়ের দক্ষিণ পর্যন্ত আর্যাবর্ত প্রসারিত।(বাংলা হিমালয়ের দক...