Skip to main content

ধর্মঠাকুর: রাঢ়ের রহস্যময় দেবতা, ইতিহাস না লোকবিশ্বাস?

ধর্ম ঠাকুর বা ধর্মরাজ রাঢ় তথা মালভূমি অঞ্চলের প্রধান হিন্দু দেবতা। 

আমাদের দেশের তথাকথিত ঐতিহাসিকেরা ধর্মরাজকে প্রাথমিকভাবে বৌদ্ধ বলে মনে করলেও, পরবর্তীকালে নীহাররঞ্জন রায়ের মতো ঐতিহাসিক প্রমাণ করেছেন ধর্মরাজের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের কোনো সংযোগ নেই।

তিনি এই পূজোকে অনার্য পূজো বলেছেন। কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, এতে ব্রাহ্মণ পুরোহিত লাগে না। তবে এই যুক্তি কতটা ঠিক, সে নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সারা ভারতে অনেক মন্দির রয়েছে, যেখানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত নেই। তাঁরা পরম্পরা অনুযায়ী পূজো করেন। কুলাচার ও দেশাচারকে মান্যতা স্বয়ং মনু দিয়েছেন।  

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, "ধর্ম, যিনি সর্বোচ্চ দেবতা, সৃষ্টিকর্তা এবং বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বিধাতা হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন, এমনকি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের থেকেও উচ্চতর, এবং কখনো কখনো তাঁদের সঙ্গে অভিন্ন হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের কোনো বিমূর্ততা নেই।"

শুধু তাই নয়, ধর্মঠাকুর শুভ্র নিরঞ্জন। আদিম লোকদের বিশ্বাস সূর্যের রং সাদা এবং তার বাহন ঘোড়ায় টানা রথ। এ থেকে সূর্যের প্রতীক ধর্মকেও মনে করা হয় শুভ্র এবং তাঁর পূজোর সময় তাঁকে কাঠের ঘোড়ায় চড়ানো হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মঠাকুরের পূজোর সময় মাটির ঘোড়া উপহার দেওয়ার প্রথাও প্রচলিত আছে। ধর্মঠাকুরের বাহন সাদা ঘোড়া এবং সাদা ফুল তাঁর প্রিয়। তাঁর আসল প্রতীক পাদুকা। কী বুঝলেন তবে? যে দেবতার বাহন ঘোড়া, তিনি আর যাই হোন অনার্য দেবতা নন। কারণ আর্য আগমন তত্ত্ব অনুযায়ী আর্য জাতি ভারতে ঘোড়া নিয়ে আসে।  

ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেল ধর্মরাজ না তো অনার্য দেবতা, না বৌদ্ধ দেবতা। দেখুন, হিন্দু শাস্ত্র মতে সূর্যদেব সাদা ঘোড়ায় টানা রথে ভ্রমণ করেন, যা কিনা লোকমতে ধর্মরাজের সাথে মিলে যায়।  

তবে এখানে আরও এক আপত্তি আছে। অনেকে বলেন, ধর্মমঙ্গল ছাড়া আর কোনো মূল হিন্দু শাস্ত্রে নাকি ধর্মরাজের নাম বা পূজোর উল্লেখ মেলে না। এমনকি গুগল সার্চও তাই বলছে। আমি পূর্বে অনেকবার বলেছি, এবারও বলছি—শাস্ত্র বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে গুগল না করে পরম্পরাগত গুরুদের কাছে যান।  

আমি পুরাণ নয়, একদম স্মৃতি শাস্ত্র থেকেই প্রমাণ দিচ্ছি। বিষ্ণু স্মৃতির ৯০ অধ্যায়ের ২৮তম শ্লোকে বলা হচ্ছে—  

"চতুর্দশীতে নদীর জলে স্নান করে ধর্মরাজ পূজো দিলে সব পাপ মুছে যায়।"

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি স্মৃতির স্থান বেদের পরেই। এবং ঐতিহাসিকভাবে বিষ্ণু স্মৃতি ২০০০ বছর আগে লেখা।  

ধর্ম ঠাকুর কিংবা ধর্মরাজ সম্পূর্ণভাবে একজন বৈদিক হিন্দু দেবতা। তাই শুধুমাত্র হিন্দুরাই তাঁর পূজো করেন।  


Comments

Popular posts from this blog

বঙ্গে রামনবমী

প্রায় কিছু বৎসর পূর্ব হইতে দেখছি যীশু-পূজা, রমজান, ঈদ পালন করা কলকাতার বাবুগণ রামনবমী পালন হতে দেখিলে ত্রাহি ত্রাহি রব তোলেন। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে—রামের প্রভাব বাড়িলে তাঁদের বেল্লাপনা বন্ধ হইবে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির উপর আরব ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন বন্ধ হবে। কিন্তু সরাসরি ভারত সম্রাটের বিরোধিতা করিলে, পাছে বাঙালি ক্ষেপে গিয়ে জুতোপেটা করে, তাই ভয়ে ভয়ে এখন বলছে—"রামনবমী বাংলার সংস্কৃতিতে ছিল না, বাঙালি এই অবাঙালি আগ্রাসন মানবে না…" ইত্যাদি ইত্যাদি। কেহ কেহ আবার হুতুম পেঁচার নকশা হইতে দেখাইতেছেন রামলীলাকে খোট্টা উৎসব বলে। তাঁরা লিখছেন—বাঙালির রাম বলতে রামমোহন ও রামকৃষ্ণ। এদের মতো নিরেট মাথামোটা বিশ্বভ্রমণ করলেও অল্পই মিলবে। রামমোহন নিজ পত্রের অন্তে পরিচয় হিসাবে নিজেকে "শ্রী রামের দাস" হিসেবে উল্লেখ করেন। আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কুলদেবতা তো স্বয়ং রঘুবীর। এসব নয়, পরে আলোচনা করা যাবে। আগেও বহুবার বলেছি—কলকাতার বাবুদের বাংলা সম্পর্কে ধারণা কম। তাই Xmas বাঙালির উৎসব আর রামনবমী অবাঙালি হয়ে যায়! মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় বহু ৩০০-৪০০ বছর পুরোনো রাম মন্দির( আরও জানতে )দে...

বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য: আর্য-অনার্য বিতর্কের ঐতিহাসিক সত্য

প্রাচীন শাস্ত্র ও ঐতিহাসিক দলিলে বারবার "বঙ্গ" শব্দের উল্লেখ থাকলেও "বাংলা" শব্দটি অনুপস্থিত। নাম নিয়ে অনেকের ধারণা থাকতে পারে, "নামে কী বা আসে যায়?" কিন্তু এখানে নামের গুরুত্ব ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, প্রাচীন বঙ্গ আজকের সম্পূর্ণ বাংলা অঞ্চলকে নির্দেশ করে না। মহাভারতের যুগে তমলুক, পুণ্ড্র এবং অঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে বঙ্গ একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা ছিল, যা আজকের বাংলার সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত নয়। দাবির বিশ্লেষণ: বঙ্গ কি অনার্য ভূমি? অনেকে দাবি করেন যে, বাঙালায় বাইরের কেউ এলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো, কারণ বঙ্গ অনার্য ভূমি। এই তথ্য বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেই বিভ্রান্তি রয়েছে।  "কারণ বঙ্গ অনার্যভূমি" এই উল্লেখ নেই। ওটা বামপন্থীদের কল্পনা। বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে যা বলা হয়েছে, তা ব্রাহ্মণদের জন্য প্রযোজ্য: [শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ বলেছি তার কারণ হলো, পরবর্তীতে অনেক রাজা বঙ্গের রাজাদের সাথে যুদ্ধে, বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এসেছিলেন। তারা প্রা...

আর্যাবর্তের প্রকৃত সংজ্ঞা: শাস্ত্র কি বলে?

একসময় যে বাংলায় রঘুনাথ স্মার্তি ও মধুসূদন সরস্বতীর মতো শাস্ত্রজ্ঞানীরা বিরাজমান ছিলেন, সেই বাংলায় আজ হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা মিথ্যাচার চলছে। এটা চলতে পারার মূলত দুটো কারণ রয়েছে। এক, গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরা সামাজিক মাধ্যম চালাতে জানেন না। দুই, বিগত ৪০ বছরের নাস্তিক শাসন হিন্দুদের থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ কেড়ে নিয়ে সেগুলো চরম হিন্দুবিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছে। তবুও, পরম্পরাগত হিন্দুরা আবার নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। আজকের আলোচনার বিষয় আর্যাবর্তের সীমারেখা। নানা সময়ে বিতর্কে দেখেছি, এই আর্যাবর্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তথাকথিত ডানপন্থী হিন্দুরা হয় অস্বস্তিতে পড়েন, নয়তো এড়িয়ে যান। স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না। দেখুন, শাস্ত্রে আর্যবর্তের তিন প্রকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমি একে একে বলছি: ১.মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাইশতম শ্লোকটি দেখুন।এই শ্লোক অনুযায়ী, আজকের পুরো ভারতই আর্যাবর্ত। শুধু তাই নয়, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রের (1.9) প্রথম অধ্যায়ে মনুস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে হিমালয়ের দক্ষিণ পর্যন্ত আর্যাবর্ত প্রসারিত।(বাংলা হিমালয়ের দক...