Skip to main content

রামায়ণ ও পুরাণ বাংলা ভাষায় শ্রবণ করলে নরকগামী? জানুন বিভ্রান্তিকর শ্লোকের পেছনের সত্য

 নমস্কার, গৌড়ীয় সেনা বলছি। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি সংস্কৃত শ্লোক ঘোরাফেরা করছে। এই শ্লোকের বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ দেখিয়ে বলা হচ্ছে, কেউ যদি আঠারো পুরাণ ও রামায়ণ বাংলায় শ্রবণ করে তবে সে রৌরব নামক নরকে যাবে। এর মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে যে, হিন্দু ধর্ম বাংলা ভাষা বিরোধী ছিল।

এবার আসি মূল বিষয়ে। শ্লোকটির ভাষাগত বিশ্লেষণে কোনো ব্যাকরণগত ভুল চোখে পড়েনি, অর্থাৎ এটি সংস্কৃতের জ্ঞানসম্পন্ন কারো রচনা হতে পারে। তবে রামায়ণ, মহাভারত বা আঠারো পুরাণে কোথাও অন্য কোনো ভাষার প্রতি নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়নি। সুতরাং, এই শ্লোকটি হয়তো মধ্যযুগের বা তারও পূর্বের কোনো রচনা হতে পারে।  


আপনি বলবেন, সে যেকোন সময়ের হোক, তবে বাংলা ভাষার প্রতি এই বিদ্বেষ কেন? এখানেই আসল তত্ত্বটি রয়েছে। শ্লোকটির অর্থ বিকৃত করা হয়েছে। ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, শ্লোকটিতে ‘বঙ্গ,’ ‘পুণ্ড্র,’ ‘গৌড়’ ইত্যাদি শব্দ নেই। শ্লোকটি আসলে বলছে, রামায়ণ বা অষ্টাদশ পুরাণ যদি সংস্কৃত ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় শ্রবণ করা হয়, তবে রৌরব নরকে যেতে হবে। সুতরাং, এখানে কেবল বাংলাই নয়—হিন্দি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি কিংবা যে কোনো ভাষাই এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।


তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে বলা যায়, শ্লোকটির কোনো প্রামাণ্য উৎস নেই। হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যবাহী গুরুদের কাছ থেকে এই ধরনের ধারণা কখনও প্রচলিত হয়নি। পঞ্চানন তর্করত্নের মতো বিদ্বান পণ্ডিতরা, যাদের খ্যাতি কাশী পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল, বাংলা ভাষায় পুরাণের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানেও পুরীর জগদগুরু শঙ্করাচার্য কখনো রামচরিতমানস বা রামায়ণ পাঁচালীর বিরোধিতা করেননি; বরং সমর্থন করেছেন।

লক্ষণ সেনের ২৬তম রাজ্যাভিষেকে শ্রীধর দাস "সদুক্তিকর্ণামৃত"-এর সংকলন শেষ করেন। সেখানে একটি শ্লোক রয়েছে,

ঘন রসময়ী গভীরা বিক্রম সুভগোপজীবিতা কবিভিঃ।  অবগাঢ়া চ পুনীতা গঙ্গা বঙ্গালবাণী চ।

অনুবাদ: বাংলা ঘনরসময়ী, গভীর এবং মনোহর।  কবিগণ এর সুধা উপভোগ করেন। গঙ্গায় স্নান করলে যেমন পুণ্য লাভ হয়, বাংলা ভাষায় অবগাহন করলে সেরূপ পুণ্য লাভ হয়।


 শেষে এটাই বলব ওই শ্লোক "অষ্টাদশ পুরাণানি... রৌরভ..." ১৯০০ সালের পর থেকে কিছু বইতে পাওয়া গেলেও এর কোনো নির্ভরযোগ্য উৎস বা লেখক উল্লেখ করা নেই। তাই আমার বক্তব্য এটাই যে, অপ্রামাণ্য তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করবেন না। বাঙালি মানে শুধুই হিন্দু । আরবের দস্যু বা ইউরোপের দালালরা বাঙালি হতে পারে না।

Read it : বাংলা ভাষার প্রতি বিদ্বেষ: মুসলিম সমাজের ঐতিহাসিক বিরোধিতা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি বিতৃষ্ণা

Comments

Popular posts from this blog

বঙ্গে রামনবমী

প্রায় কিছু বৎসর পূর্ব হইতে দেখছি যীশু-পূজা, রমজান, ঈদ পালন করা কলকাতার বাবুগণ রামনবমী পালন হতে দেখিলে ত্রাহি ত্রাহি রব তোলেন। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে—রামের প্রভাব বাড়িলে তাঁদের বেল্লাপনা বন্ধ হইবে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির উপর আরব ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন বন্ধ হবে। কিন্তু সরাসরি ভারত সম্রাটের বিরোধিতা করিলে, পাছে বাঙালি ক্ষেপে গিয়ে জুতোপেটা করে, তাই ভয়ে ভয়ে এখন বলছে—"রামনবমী বাংলার সংস্কৃতিতে ছিল না, বাঙালি এই অবাঙালি আগ্রাসন মানবে না…" ইত্যাদি ইত্যাদি। কেহ কেহ আবার হুতুম পেঁচার নকশা হইতে দেখাইতেছেন রামলীলাকে খোট্টা উৎসব বলে। তাঁরা লিখছেন—বাঙালির রাম বলতে রামমোহন ও রামকৃষ্ণ। এদের মতো নিরেট মাথামোটা বিশ্বভ্রমণ করলেও অল্পই মিলবে। রামমোহন নিজ পত্রের অন্তে পরিচয় হিসাবে নিজেকে "শ্রী রামের দাস" হিসেবে উল্লেখ করেন। আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কুলদেবতা তো স্বয়ং রঘুবীর। এসব নয়, পরে আলোচনা করা যাবে। আগেও বহুবার বলেছি—কলকাতার বাবুদের বাংলা সম্পর্কে ধারণা কম। তাই Xmas বাঙালির উৎসব আর রামনবমী অবাঙালি হয়ে যায়! মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় বহু ৩০০-৪০০ বছর পুরোনো রাম মন্দির( আরও জানতে )দে...

বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য: আর্য-অনার্য বিতর্কের ঐতিহাসিক সত্য

প্রাচীন শাস্ত্র ও ঐতিহাসিক দলিলে বারবার "বঙ্গ" শব্দের উল্লেখ থাকলেও "বাংলা" শব্দটি অনুপস্থিত। নাম নিয়ে অনেকের ধারণা থাকতে পারে, "নামে কী বা আসে যায়?" কিন্তু এখানে নামের গুরুত্ব ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, প্রাচীন বঙ্গ আজকের সম্পূর্ণ বাংলা অঞ্চলকে নির্দেশ করে না। মহাভারতের যুগে তমলুক, পুণ্ড্র এবং অঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে বঙ্গ একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা ছিল, যা আজকের বাংলার সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত নয়। দাবির বিশ্লেষণ: বঙ্গ কি অনার্য ভূমি? অনেকে দাবি করেন যে, বাঙালায় বাইরের কেউ এলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো, কারণ বঙ্গ অনার্য ভূমি। এই তথ্য বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেই বিভ্রান্তি রয়েছে।  "কারণ বঙ্গ অনার্যভূমি" এই উল্লেখ নেই। ওটা বামপন্থীদের কল্পনা। বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে যা বলা হয়েছে, তা ব্রাহ্মণদের জন্য প্রযোজ্য: [শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ বলেছি তার কারণ হলো, পরবর্তীতে অনেক রাজা বঙ্গের রাজাদের সাথে যুদ্ধে, বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এসেছিলেন। তারা প্রা...

আর্যাবর্তের প্রকৃত সংজ্ঞা: শাস্ত্র কি বলে?

একসময় যে বাংলায় রঘুনাথ স্মার্তি ও মধুসূদন সরস্বতীর মতো শাস্ত্রজ্ঞানীরা বিরাজমান ছিলেন, সেই বাংলায় আজ হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা মিথ্যাচার চলছে। এটা চলতে পারার মূলত দুটো কারণ রয়েছে। এক, গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরা সামাজিক মাধ্যম চালাতে জানেন না। দুই, বিগত ৪০ বছরের নাস্তিক শাসন হিন্দুদের থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ কেড়ে নিয়ে সেগুলো চরম হিন্দুবিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছে। তবুও, পরম্পরাগত হিন্দুরা আবার নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। আজকের আলোচনার বিষয় আর্যাবর্তের সীমারেখা। নানা সময়ে বিতর্কে দেখেছি, এই আর্যাবর্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তথাকথিত ডানপন্থী হিন্দুরা হয় অস্বস্তিতে পড়েন, নয়তো এড়িয়ে যান। স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না। দেখুন, শাস্ত্রে আর্যবর্তের তিন প্রকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমি একে একে বলছি: ১.মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাইশতম শ্লোকটি দেখুন।এই শ্লোক অনুযায়ী, আজকের পুরো ভারতই আর্যাবর্ত। শুধু তাই নয়, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রের (1.9) প্রথম অধ্যায়ে মনুস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে হিমালয়ের দক্ষিণ পর্যন্ত আর্যাবর্ত প্রসারিত।(বাংলা হিমালয়ের দক...