নমস্কার, গৌড়ীয় সেনা বলছি।
মা দুর্গাকে নিয়ে যে সমস্ত অপবাদ বামপন্থী প্রোপাগান্ডাবাদীরা ছড়িয়েছে, তার আজ আমরা জবাব দেব। ওদের মতে, মা দুর্গা একজন "বেশ্যা," যিনি মহিষাসুরকে ছল করে হত্যা করেন।
চাইলে এই প্রতিবেদনটি পড়ে দেখতে পারেন।
অথচ দেখুন, এত বড় একটা পত্রিকা বাংলায় মা দুর্গার নামে এইসব লিখে প্রকাশ করলো, আর বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা চুপ। ওহ, আমি ভুলে গেছিলাম, ওরা তো পেরিয়ারকে অনুসরণ করে। তাই ওদেরও মা দুর্গা সম্পর্কে একই মতামত। শুধু বাঙালিরা এখনও মা দুর্গাকে শ্রদ্ধা করেন বলে ভয়ে প্রকাশ্যে বলতে পারেনি। নাহলে শ্রী রামের প্রতি ওদের ঘৃণা তো সবাই জানে।
সে যাই হোক, আসুন আসল কথায়।
দেখুন, সাঁওতাল সমাজে এরকম লোককথা ছিল কি না, বা এটি পরে তৈরি করা হয়েছে—সে বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো। তবে, যে সাঁওতালদের বামপন্থীরা "অনার্য" বলে থাকে, সেই অনার্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রাজা আর্য কীভাবে হতে পারেন?
হ্যাঁ, মহিষাসুরের বংশপরিচয় তাঁকে আর্য বলছে।
প্রথমত, মহিষাসুরের বংশ পরম্পরা দেবী ভাগবতম, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এবং কালিকাপুরাণে সযত্নে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ব্রহ্মার পুত্র মারীচি, মারীচির পুত্র কশ্যপ। কশ্যপমুনির পুত্র রম্ভ, আর রম্ভের পুত্র অর্থাৎ কশ্যপের পৌত্র হলেন মহিষা। মহিষ (মহিষাসুর) শিবের একনিষ্ঠ উপাসক ছিলেন।
আরেকটা প্রশ্ন, যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো দুর্গাপূজা তো প্রতিবছর একই সময় হয় না। পূজা হিন্দু জ্যোতিষ অনুযায়ী হয়। তাহলে কি আদিবাসী ভাইয়েরা হিন্দু জ্যোতিষ মানেন? ওটা মেনেই কি হুদুড় দুর্গার জন্য শোক পালন করা হয়?
দেখুন, তাঁরা মানেন এবং দুর্গাপূজাও করেন।
আরেকটা প্রশ্ন, এই সমস্ত বামপন্থীরা দাবি করে থাকেন যে অসুর নাকি অনার্য দেবতা। এটার পর্দাফাঁস বঙ্কিম বাবু একশো বছর আগেই করেছিলেন। আমি আরেকটু বিস্তারে বলি...
প্রাচীন বৈদিক সাহিত্য অনুসারে, শুভ অসুরদের আদিত্য বলা হয় এবং তাদের নেতৃত্বে থাকেন বরুণ, অপরদিকে দুষ্ট অসুরদের দানব বলা হয় এবং তাদের নেতৃত্বে থাকেন বৃত্র। বৈদিক সাহিত্যের প্রাথমিক স্তরে অগ্নি, ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতাদেরও অসুর বলা হয়েছে, কারণ তারা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্র, জ্ঞান এবং ক্ষমতার "প্রভু" বা অধিপতি ছিলেন।
তবে কি আদিবাসীরা আর্য দেবতার পূজা করতেন?
এই সমস্ত পাতি বামপন্থী প্রোপাগান্ডার দিন শেষ, মশাই।
এবার আসুন, আরেকটু গভীর আলোচনা করি। হুদুর দুর্গা নিয়ে ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক বা নৃগবেষণামূলক কোনো প্রমাণ নেই। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর গবেষণা চালিয়েছেন, তাঁরাও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
১৯২১ সালে শরতচন্দ্র দে তাঁর Mundas and their Country বইয়ে হুদুর দুর্গার উল্লেখ করেননি। ১৯২৬ সালে জন ব্যাপটিস্ট হফম্যানের বিশাল পরিসরে রচিত ১৫ খণ্ডের Encyclopedia Mundarica-তে মুন্ডা জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিয়ম, কল্পকথা, কিংবদন্তি, ভূতপ্রেত, মহাজাগতিকতা, লোকউৎসব প্রভৃতি বিশদে তুলে ধরা হয়েছে। এখানেও হুদুর দুর্গার কোনো উল্লেখ নেই।
ইতিহাসবিদ ও নৃ-গবেষক কে কে লেউভা, যিনি রাঁচিতে তফসিলি জাতি ও উপজাতি বিভাগের সহকারী কমিশনার ছিলেন, তাঁর দীর্ঘ গবেষণা The Asur - A Study of Primitive Iron Smelters (১৯৭৩)-এও হুদুর দুর্গার কোনো উল্লেখ নেই। একইভাবে, বিহার ট্রাইবাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বুলেটিন (১৯৬৪), নর্মদেশ্বর প্রসাদের Tribal People of Bihar (১৯৬১), কে এস সিংয়ের Tribes of India (১৯৯৪), এম কুজুরের Asurs and their Dancers (১৯৯৬)-এও হুদুর দুর্গার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
নদীম হাসনাইনের Tribal India গ্রন্থ, যা ভারতীয় উপজাতিদের ওপর একটি গবেষণাধর্মী রচনা, তাতেও হুদুর দুর্গার প্রসঙ্গ নেই।
এইসব প্রামাণ্য উৎস অনুসারে, অস্ট্রো-এশিয়াটিক আসুর গোষ্ঠী ঝাড়খণ্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং উড়িষ্যায় বাস করে। এদের তিনটি শাখা আছে—বীর আসুর, বীরজা আসুর, এবং আগর আসুর। এরা পাথর দেখে তা লৌহ আকরিক কিনা বুঝতে পারত এবং নিজস্ব লোকপ্রযুক্তি ব্যবহার করে লোহা গলিয়ে অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি তৈরি করত। ধারণা করা হয়, মৌর্য সাম্রাজ্যের সাফল্যে এদের নির্মিত লৌহাস্ত্র একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
তবে ১৯০৮ সালে টাটা স্টিল কারখানা প্রতিষ্ঠার পর এদের ঐতিহ্যবাহী প্রযুক্তি ধাক্কা খায়, কারণ কলোনিয়াল সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাণিজ্যিক ব্লাস্ট ফার্নেস প্রযুক্তি চালু হয়। এর ফলে এদের প্রাচীন দক্ষতাগুলো ক্রমে হারিয়ে যায়।
২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, ভারতে প্রায় ৩৩,০০০ আসুর জনগোষ্ঠী রয়েছে—পশ্চিমবঙ্গে ৪৯৮, ঝাড়খণ্ডে ২২,৪৫৯, এবং বিহারে ৪,১২৯ জন। এদের ভাষা আসুরিক, যা মুন্ডারি উপভাষার অংশ। তবে এটি খুব কম মানুষই এখন ব্যবহার করে।
জলপাইগুড়ির নাগরাকাটার কেয়ার্ন চা-বাগানে বসবাসকারী ১০১টি আসুর পরিবারের মধ্যে ৯০টি পরিবারই মিশনারিদের প্রচেষ্টায় খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। এছাড়াও বানারহাট, চালসা ও ডুয়ার্সের অন্যান্য অঞ্চলেও এদের বাস।
এরা নিজেদের পূর্বপুরুষ হিসেবে মহিষাসুরকে মানে। এটি কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নয়। যেমন কনৌজের কন্যাকুব্জ ব্রাহ্মণরা নিজেদের রাবণের বংশধর মনে করে, যাদবরা শ্রীকৃষ্ণের বংশধর বলে মনে করে। হিমাচল প্রদেশে দুর্যোধনকে নিয়ে মন্দির রয়েছে, যেখানে স্থানীয়রা দুর্যোধনকে পূজা করে।
ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিজেদের পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছে, তবে ধর্ম অনুসরণের কারণে সবাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থেকেছে। কিন্তু একটি বিশেষ চক্র ইতিহাসের প্রমাণ ছাড়াই একটি কৃত্রিম গোষ্ঠী তৈরি করে বিভেদ ঘটানোর চেষ্টা করছে।
গবেষক মৃদুলকান্তি ঘোষ তাঁর একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, দশাঁই উৎসব প্রকৃতপক্ষে কৃষি ও প্রকৃতি পূজার উৎসব। এটি যুদ্ধ বা হুদুর দুর্গা কিস্কুর কোনো কাহিনি নয়। "দশাঁই" শব্দের অর্থ হচ্ছে "দহ+অংশ+আয়"—যার মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির দেবীর পূজা করে জল কামনা করা, কোনো যুদ্ধজয়ের স্মরণ নয়।
উৎসবের গানের প্রথম পংক্তিতেই এর স্পষ্টতা পাওয়া যায়। "হায় রে, হায় রে" একধরনের আহ্বান প্রকৃতি দেবীর প্রতি, যাতে তিনি আবির্ভূত হন এবং দেশ ও জনগণের মঙ্গল করেন।
Comments
Post a Comment