Skip to main content

বাংলা ভাষার প্রতি বিদ্বেষ: মুসলিম সমাজের ঐতিহাসিক বিরোধিতা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি বিতৃষ্ণা

নমস্কার গৌড়ীয় সেনা বলছি,


এর আগের লেখাতেই আরবীয় দস্যুদের অভিযোগ খণ্ডন করেছি যে "হিন্দুরা বাংলা ভাষার বিরোধী।" এবার দেখা যাক, আরবীয় দস্যু তথা কলকাতার বাবুদের ভাষায় বাঙালি মুসলমান, যারা আরবীয় সংস্কৃতির অনুসারী, বাংলা নিয়ে কী বক্তব্য প্রকাশ করেছেন।

শাস্ত্রকথার বাংলা ভাষায় তর্জমার প্রতিবাদে মুসলমান সমাজ খ্রিস্টীয় সতেরো শতক পর্যন্তও মুখর ছিল। সেই সময়ের বিভিন্ন কবির কাব্য থেকে তাদের অবস্থানের আভাস পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ তীব্র প্রতিবাদও করেছিলেন। যেমন, শাহ মুহম্মদ সগীর (১৩৮৯-১৩৯০ খ্রিস্টাব্দে) লিখেছিলেন –

নানা কাব্য-কথা-রসে মজে নবগণ  

যার যেই শ্রদ্ধায়ে সন্তোষ করে মন।  

না লেখে কিতাব কথা মনে ভয় পায়  

দূষিব সকল তাক ইহ না জুজায়।  

গুণিয়া দেখিলু আহ্মি ইহ ভয় মিছা  

না হয় ভাষায় কিছু হএ কথা সাচা।

১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ সুলতান বলেছিলেন –  

কর্মদোষে বঙ্গেত বাঙালি উৎপন  

না বুঝে বাঙালি সবে আরবী বচন।  

ফলে, আপনা দীনের বোল এক না বুঝিলা  

            প্রস্তাব পাইয়া সব ভুলিয়া বহিলা।  

কিন্তু যাবে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন  

            সেই ভাষা হয় তার অমূল্য রতন।  

তবু, যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে।  

          পঞ্চালি বচিলু কবি আছেত দূষিতে।  

         মুনাফিক বোলে মোরে কিতাবেতে পড়ি  

         কিতাবের কথা দিলু হিন্দুয়ানি করি।  

অবশ্য, মোহোর মনের ভাব জানে করতারে  

                যথেক মনের কথা কহিমু কাহারে।  

খ্রিস্টীয় ষোলো শতকে হাজী মুহম্মদও এই বিষয়ে বলেছিলেন – 

যে-কিছু করিছে মানা না করিঅ তারে  

ফরমান না মানিলে আজাব আখেরে।  

হিন্দুয়ানি লেখা তারে না পারি লিখিতে  

কিঞ্চিত কহিলু কিছু লোকে জ্ঞান পাইতে।

তাঁর পরবর্তী কবি মুতালিবেরও (১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে) এই বিষয়ে বক্তব্য ছিল –  

আরবীতে সকলে না বুঝে ভাল মন্দ  

তে কারণে দেশী ভাষে রচিলু প্রবন্ধ।  

মুসলমানি শাস্ত্র কথা বাঙলা করিলু  

বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলু।  

‘আমীর হামজা’ (১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে) রচয়িতা আবদুন নবীর বক্তব্য –  

মুসলমানী কথা দেখি মনে ডরাই  

রচিলে বাঙলা ভাষে কোপে কি গোঁসাই।  

লোক উপকার হেতু তেজি সেই ভয়  

দৃঢ়ভাবে রচিবারে ইচ্ছিল হৃদয়।

এমন চিন্তাভাবনার কারণ কি জানেন? কারণ, বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বহিরাগত। ফজলে রব্বী খান বাহাদুর তাঁর গ্রন্থ ‘হকিকতে মুসলমানে বাঙ্গালা’ (ইংরেজি অনুবাদ: ‘The Origin of the Musalmans of Bengal, 1895 A.D.’) - এ প্রমাণ করেছিলেন যে, বাঙালি মুসলমানেরা প্রায় সকলেই বহিরাগত। 

এমনকি, ১৯০১ সালের আদমশুমারিতেও মুসলিমরা নিজেদের অবাঙালি বলে দাবি করেছিল। তারা বাঙালিদের মুনাফিক এবং নিচু মনে করত এবং বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা বলত।

                    ●বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – শ্রী অতুল সুর

সপ্তদশ শতকের কবি রাজ্জাক নন্দন আবদুল হাকিম বলেছিলেন:  

যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ  

সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।  

মারফত ভেদে যার নাহিক গমন  

হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।  

যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।

এখানে লক্ষ্য করুন, তিনি "আল্লাহ" নয় বরং "নিরঞ্জন" শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এটা দেখাচ্ছে যে, বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর বিশেষ প্রেম ছিল। 

১৯০০ সালের পরও তথাকথিত বাঙালি মুসলমানদের উর্দু-প্রেম ও বাংলার প্রতি বিদ্বেষ কমেনি। মুসলিমরা বাংলাকে কাপুরুষদের ভাষা বলে চিহ্নিত করেছিল। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ‘হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার জীবন-চরিত’ গ্রন্থের ভূমিকায় মোহাম্মদ রেয়াজদ্দিন আহমদ লিখেছিলেন –

উর্দু ভাষা না থাকিলে আজ ভারতের মোসলমানগণ জাতীয়তাবিহীন ও কিরূপ দুর্দশাগ্রস্ত হইত, তাহা চিন্তা করিবার বিষয়। বাঙ্গলা দেশের মোসলমানদের মাতৃভাষা বাঙ্গলা হওয়ায়, বঙ্গীয় মোসলমান জাতির সর্বনাশ হইয়াছে। এই কারণে তাঁহারা জাতীয়তাবিহীন নিস্তেজ দুর্বল ও কাপুরুষ হইয়া গিয়াছে।

এরপরও, ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা বলত। ১৩১০ বঙ্গাব্দের ‘নবনূর’ পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যায় সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিম একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন –

বাঙ্গালা ভাষা হিন্দুগণের ভাষা।

১৮৮৮ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘হিন্দু-মুসলমান’ গ্রন্থের লেখক শেখ আবদুস সোবহান লিখেছিলেন –

আমি জাতিতে মোসলমান, – বঙ্গভাষা আমার জাতীয় ভাষা নহে।

এটি একদমই সত্য কথা। বাংলা ভাষা, বাংলা মাটি সবই বাঙালি হিন্দুদের।

বুঝুন, কান্ড। তথাকথিত বাঙালি মুসলমানরা মনে করত, খারাপ কর্মের জন্য তাদের জন্ম বাংলায় হয়েছে। তাদের মাজহাবী কিতাব ছাড়ুন, মশাই, প্রবন্ধটুকু বাংলায় লিখলে পাপ হবে, এমনটা ভাবত তৎকালীন মুসলমানরা। তবে, যদি লেখাগুলো একটু লক্ষ্য করেন, তাহলে বুঝবেন, তাতে শাস্ত্র, প্রভু, পাপ, নিরঞ্জনের মতো শব্দের ব্যবহার হয়েছে। যা আজ কোনো বাংলাদেশি মুসলমান ব্যবহার করেন না। তার বদলে তারা নতুন আরবি ও উর্দু শব্দ বাংলা ভাষায় সংযোজন করেছে।

এইভাবে ধীরে ধীরে তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে, যদি আমি বা আপনি না জাগি। পিতা, মাতা-র পরিবর্তে আব্বু, আম্মু ব্যবহার হবে এই বাংলায়। নমস্কারের পরিবর্তে আসসালামু আলাইকুম ব্যবহার হবে। নিরঞ্জনের (বিষ্ণু) বদলে আল্লাহ ব্যবহৃত হবে এই বাংলায়।

নিরঞ্জন শ্রী কৃষ্ণের নাম। বঙ্কিম বাবু যথার্থই বলেছিলেন,

বাঙ্গালীর বিশ্বাস- 

কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং।

অর্থাৎ কৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান।

তাই তৎকালীন মৌলবিরা শ্রী কৃষ্ণকে এড়িয়ে বাঙালীর কাছে পৌঁছাতে পারেননি।

ওই যে বললাম 

শ্রী কৃষ্ণ বঙ্গদেশে সর্বব্যাপক।

হিন্দুরা যতদিন এই ভূমিতে আছে, ততদিন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সব থাকবে।

তাহলে ভাবুন, মুসলমানরা হিন্দুদের উপর আনিত অভিযোগগুলোর জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট উৎস দেখাতে পারেনি, অথচ আমি তাদের বাংলা ভাষা এবং বাঙালি ঘৃণার প্রমাণসমেত তথ্য দিলাম।  

এটা মনে রাখবেন, আজকের পরিস্থিতির চাপে তারা বাঙালি সেজেছে বটে, কিন্তু তাদের রক্তে বাঙালিবিদ্বেষ রয়েছে। বাঙালি মানেই বাংলা ভাষী হিন্দু।

Comments

  1. ধন লিখেছেন, সেই হৈছে 🤣🤣

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বঙ্গে রামনবমী

প্রায় কিছু বৎসর পূর্ব হইতে দেখছি যীশু-পূজা, রমজান, ঈদ পালন করা কলকাতার বাবুগণ রামনবমী পালন হতে দেখিলে ত্রাহি ত্রাহি রব তোলেন। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে—রামের প্রভাব বাড়িলে তাঁদের বেল্লাপনা বন্ধ হইবে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির উপর আরব ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন বন্ধ হবে। কিন্তু সরাসরি ভারত সম্রাটের বিরোধিতা করিলে, পাছে বাঙালি ক্ষেপে গিয়ে জুতোপেটা করে, তাই ভয়ে ভয়ে এখন বলছে—"রামনবমী বাংলার সংস্কৃতিতে ছিল না, বাঙালি এই অবাঙালি আগ্রাসন মানবে না…" ইত্যাদি ইত্যাদি। কেহ কেহ আবার হুতুম পেঁচার নকশা হইতে দেখাইতেছেন রামলীলাকে খোট্টা উৎসব বলে। তাঁরা লিখছেন—বাঙালির রাম বলতে রামমোহন ও রামকৃষ্ণ। এদের মতো নিরেট মাথামোটা বিশ্বভ্রমণ করলেও অল্পই মিলবে। রামমোহন নিজ পত্রের অন্তে পরিচয় হিসাবে নিজেকে "শ্রী রামের দাস" হিসেবে উল্লেখ করেন। আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কুলদেবতা তো স্বয়ং রঘুবীর। এসব নয়, পরে আলোচনা করা যাবে। আগেও বহুবার বলেছি—কলকাতার বাবুদের বাংলা সম্পর্কে ধারণা কম। তাই Xmas বাঙালির উৎসব আর রামনবমী অবাঙালি হয়ে যায়! মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় বহু ৩০০-৪০০ বছর পুরোনো রাম মন্দির( আরও জানতে )দে...

বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য: আর্য-অনার্য বিতর্কের ঐতিহাসিক সত্য

প্রাচীন শাস্ত্র ও ঐতিহাসিক দলিলে বারবার "বঙ্গ" শব্দের উল্লেখ থাকলেও "বাংলা" শব্দটি অনুপস্থিত। নাম নিয়ে অনেকের ধারণা থাকতে পারে, "নামে কী বা আসে যায়?" কিন্তু এখানে নামের গুরুত্ব ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, প্রাচীন বঙ্গ আজকের সম্পূর্ণ বাংলা অঞ্চলকে নির্দেশ করে না। মহাভারতের যুগে তমলুক, পুণ্ড্র এবং অঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে বঙ্গ একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা ছিল, যা আজকের বাংলার সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত নয়। দাবির বিশ্লেষণ: বঙ্গ কি অনার্য ভূমি? অনেকে দাবি করেন যে, বাঙালায় বাইরের কেউ এলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো, কারণ বঙ্গ অনার্য ভূমি। এই তথ্য বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেই বিভ্রান্তি রয়েছে।  "কারণ বঙ্গ অনার্যভূমি" এই উল্লেখ নেই। ওটা বামপন্থীদের কল্পনা। বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে যা বলা হয়েছে, তা ব্রাহ্মণদের জন্য প্রযোজ্য: [শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ বলেছি তার কারণ হলো, পরবর্তীতে অনেক রাজা বঙ্গের রাজাদের সাথে যুদ্ধে, বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এসেছিলেন। তারা প্রা...

আর্যাবর্তের প্রকৃত সংজ্ঞা: শাস্ত্র কি বলে?

একসময় যে বাংলায় রঘুনাথ স্মার্তি ও মধুসূদন সরস্বতীর মতো শাস্ত্রজ্ঞানীরা বিরাজমান ছিলেন, সেই বাংলায় আজ হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা মিথ্যাচার চলছে। এটা চলতে পারার মূলত দুটো কারণ রয়েছে। এক, গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরা সামাজিক মাধ্যম চালাতে জানেন না। দুই, বিগত ৪০ বছরের নাস্তিক শাসন হিন্দুদের থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ কেড়ে নিয়ে সেগুলো চরম হিন্দুবিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছে। তবুও, পরম্পরাগত হিন্দুরা আবার নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। আজকের আলোচনার বিষয় আর্যাবর্তের সীমারেখা। নানা সময়ে বিতর্কে দেখেছি, এই আর্যাবর্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তথাকথিত ডানপন্থী হিন্দুরা হয় অস্বস্তিতে পড়েন, নয়তো এড়িয়ে যান। স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না। দেখুন, শাস্ত্রে আর্যবর্তের তিন প্রকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমি একে একে বলছি: ১.মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাইশতম শ্লোকটি দেখুন।এই শ্লোক অনুযায়ী, আজকের পুরো ভারতই আর্যাবর্ত। শুধু তাই নয়, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রের (1.9) প্রথম অধ্যায়ে মনুস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে হিমালয়ের দক্ষিণ পর্যন্ত আর্যাবর্ত প্রসারিত।(বাংলা হিমালয়ের দক...