Skip to main content

বাংলা ভাষার আদি উৎস: সংস্কৃত নাকি প্রাকৃত? ঐতিহ্য ও ইতিহাসের এক বিতর্কিত অধ্যায়

 নমস্কার, গৌড়ীয় সেনা বলছি। আজ সামাজিক মাধ্যম চালাতে চালাতে একটি আলোচনা সভা চোখে পড়ল। সেখানে রাজর্ষি লাহিড়ীর বক্তব্য ছিল দেখার মতো। উনি বলেন যে সংস্কৃত হলো বাংলা ভাষার ঠাকুমা।

উনার বক্তব্যের শেষে একজন উঠে বললেন, “দাদা, আপনার গলার স্বর অতি সুন্দর, তবে আপনি একটি কথা ভুল বলেছেন। বাংলা ভাষার উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে নয়, মাগধী প্রাকৃত থেকে। আপনারা আর্যবর্তের লোকেরা প্রাকৃত থেকে বাংলার আগমন মানতে চান না, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা, কারণ বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ভূমিকা ছিল।”

রাজর্ষিদা উত্তর বললেন.....

আমি আরেকটু পরিষ্কার করি সবার জন্য। দেখুন, আগেও বলেছি, বাঙালি জাতি বাংলা ভাষার চেয়ে অনেক প্রাচীন। আর বাংলা ভাষার পুরো ব্যাকরণ যেখানে পাণিনির অনুকরণ মাত্র, সেখানে সীতাকে রামের বোন বলা ভাষাবিদরা কী বলল, তাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। শুধু তাই নয়, আরও শুনুন: চর্যাপদ ১০০০ বছর প্রাচীন এবং আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প বইটি ১৩০০ বছর প্রাচীন, যেখানে বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে। হঠাৎ করে বৌদ্ধদের এহেন মানসিকতার পরিবর্তন বিশ্বাসযোগ্য নয়। 

অন্যদিকে, মহাভারত এবং শৈব আগমের মতো প্রাচীন বইগুলোতে বাংলা ভাষা ও বাঙালির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। ওই ব্যক্তির আরেকটি কৌশল লক্ষ্য করুন—উনি এমনভাবে ব্যাপারটা বলেছেন যেন মাগধী প্রাকৃত অনার্য ভাষা। আসলে সেটা একদমই নয়। উনার ভাষাবিদরাই প্রাকৃতকে আর্য ভাষা গোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

সংস্কৃত সত্যিই বাংলা ভাষার ঠাকুমা কি না, তা সময় বলবে। আপাতত যে সমস্ত পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা দিয়ে বাঙলার আদি সংস্কৃতি পরিষ্কার। যেভাবে তথাকথিত বাঙালি বামপন্থী ঐতিহাসিকদের মুখোশ খুলেছি, এবার এই ভাষাবিদদেরও মুখোশ খুলব। 

 প্রাকৃত ভাষা, যেখান থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে, সেটি এসেছে সংস্কৃত থেকে।  

●প্রাচীন প্রাকৃত ব্যাকরণ প্রাকৃত প্রকাশ(১৩০০ বছর পুরানো) অনুসারে, "সংস্কৃত হলো প্রাকৃতি (মূল উৎস), এবং যে ভাষা এই প্রাকৃতি থেকে উদ্ভূত বা এসেছে, সেটি তাই প্রাকৃত নামে পরিচিত।"  

●১০ম শতাব্দীর জৈন ব্যাকরণবিদ হেমচন্দ্র (যিনি গুজরাটে বসবাস করতেন) তার সংস্কৃত ও প্রাকৃত ব্যাকরণ সিদ্ধ-হেম-শব্দানুশাসন-এ লিখেছেন, "প্রাকৃতিঃ সংস্কৃতম্, তত্রভবং ততঃ আগতম্ বা প্রাকৃতম্।" অর্থাৎ, সংস্কৃত হল প্রাকৃতি (মূল উৎস), এবং প্রাকৃত নামটি এসেছে এই কারণে যে এটি সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন হয়েছে।  


●আরেক প্রাকৃত ব্যাকরণবিদ, মার্কণ্ডেয়, তার ব্যাকরণ প্রাকৃতসর্বস্ব-এ বলেছেন, "প্রাকৃতিঃ সংস্কৃতম্, তত্রভবং প্রাকৃতম্ উচ্চ্যতে।" অর্থাৎ, সংস্কৃতকে প্রাকৃতি বা মূল উৎস বলা হয়, এবং প্রাকৃত এই উৎস থেকেই উদ্ভূত।  

●ধানিকা, তার দশরূপকটীকা ভাষ্যে (যা ভারতীয় নাটকের দশটি রূপ নিয়ে আলোচনা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ) বলেছেন, "প্রাকৃতের আগতং প্রাকৃতম্, প্রাকৃতিঃ সংস্কৃতম্।" অর্থাৎ, প্রাকৃতি (মূল উৎস) থেকে এসেছে প্রাকৃত, আর সেই প্রাকৃতি হল সংস্কৃত।  

তাহলে কি বোঝা গেল? প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে এবং প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার জন্ম।  

অতএব, সংস্কৃতকে বাংলা ভাষার ‘ঠাকুমা’ বললে একেবারে ভুল হবে না!

আরে দাঁড়ান মশাই, বাংলা সবদিনই আর্যবর্তের অন্তর্গত ছিল। মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২২তম শ্লোক দেখুন, আর্যবর্তের সংজ্ঞা পেয়ে যাবেন। 


আসছি, বন্ধুগণ।

বহুধাবিভক্ত ভারত ছোটো ছোটো রাজ্যে কেবলই কাড়াকাড়ি হানাহানি করেছে, সাধারণ শত্রু যখন দ্বারে এসেছে সকলে এক হয়ে বিদেশীর আক্রমণ ঠেকাতে পারে নি। এই শোচনীয় আত্মবিচ্ছেদ ও বহির্বিপ্লবের সময়ে ভারতবর্ষে একটিমাত্র ঐক্যের মহাকর্ষশক্তি ছিল, সে তার সংস্কৃত ভাষা।

  বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.পৃষ্ঠা ৩৮।

 

Comments

Popular posts from this blog

বঙ্গে রামনবমী

প্রায় কিছু বৎসর পূর্ব হইতে দেখছি যীশু-পূজা, রমজান, ঈদ পালন করা কলকাতার বাবুগণ রামনবমী পালন হতে দেখিলে ত্রাহি ত্রাহি রব তোলেন। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে—রামের প্রভাব বাড়িলে তাঁদের বেল্লাপনা বন্ধ হইবে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির উপর আরব ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন বন্ধ হবে। কিন্তু সরাসরি ভারত সম্রাটের বিরোধিতা করিলে, পাছে বাঙালি ক্ষেপে গিয়ে জুতোপেটা করে, তাই ভয়ে ভয়ে এখন বলছে—"রামনবমী বাংলার সংস্কৃতিতে ছিল না, বাঙালি এই অবাঙালি আগ্রাসন মানবে না…" ইত্যাদি ইত্যাদি। কেহ কেহ আবার হুতুম পেঁচার নকশা হইতে দেখাইতেছেন রামলীলাকে খোট্টা উৎসব বলে। তাঁরা লিখছেন—বাঙালির রাম বলতে রামমোহন ও রামকৃষ্ণ। এদের মতো নিরেট মাথামোটা বিশ্বভ্রমণ করলেও অল্পই মিলবে। রামমোহন নিজ পত্রের অন্তে পরিচয় হিসাবে নিজেকে "শ্রী রামের দাস" হিসেবে উল্লেখ করেন। আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কুলদেবতা তো স্বয়ং রঘুবীর। এসব নয়, পরে আলোচনা করা যাবে। আগেও বহুবার বলেছি—কলকাতার বাবুদের বাংলা সম্পর্কে ধারণা কম। তাই Xmas বাঙালির উৎসব আর রামনবমী অবাঙালি হয়ে যায়! মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় বহু ৩০০-৪০০ বছর পুরোনো রাম মন্দির( আরও জানতে )দে...

বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য: আর্য-অনার্য বিতর্কের ঐতিহাসিক সত্য

প্রাচীন শাস্ত্র ও ঐতিহাসিক দলিলে বারবার "বঙ্গ" শব্দের উল্লেখ থাকলেও "বাংলা" শব্দটি অনুপস্থিত। নাম নিয়ে অনেকের ধারণা থাকতে পারে, "নামে কী বা আসে যায়?" কিন্তু এখানে নামের গুরুত্ব ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, প্রাচীন বঙ্গ আজকের সম্পূর্ণ বাংলা অঞ্চলকে নির্দেশ করে না। মহাভারতের যুগে তমলুক, পুণ্ড্র এবং অঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে বঙ্গ একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা ছিল, যা আজকের বাংলার সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত নয়। দাবির বিশ্লেষণ: বঙ্গ কি অনার্য ভূমি? অনেকে দাবি করেন যে, বাঙালায় বাইরের কেউ এলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো, কারণ বঙ্গ অনার্য ভূমি। এই তথ্য বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেই বিভ্রান্তি রয়েছে।  "কারণ বঙ্গ অনার্যভূমি" এই উল্লেখ নেই। ওটা বামপন্থীদের কল্পনা। বৌধ্যায়ন ধর্মসূত্রে যা বলা হয়েছে, তা ব্রাহ্মণদের জন্য প্রযোজ্য: [শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ বলেছি তার কারণ হলো, পরবর্তীতে অনেক রাজা বঙ্গের রাজাদের সাথে যুদ্ধে, বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এসেছিলেন। তারা প্রা...

আর্যাবর্তের প্রকৃত সংজ্ঞা: শাস্ত্র কি বলে?

একসময় যে বাংলায় রঘুনাথ স্মার্তি ও মধুসূদন সরস্বতীর মতো শাস্ত্রজ্ঞানীরা বিরাজমান ছিলেন, সেই বাংলায় আজ হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা মিথ্যাচার চলছে। এটা চলতে পারার মূলত দুটো কারণ রয়েছে। এক, গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরা সামাজিক মাধ্যম চালাতে জানেন না। দুই, বিগত ৪০ বছরের নাস্তিক শাসন হিন্দুদের থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ কেড়ে নিয়ে সেগুলো চরম হিন্দুবিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছে। তবুও, পরম্পরাগত হিন্দুরা আবার নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। আজকের আলোচনার বিষয় আর্যাবর্তের সীমারেখা। নানা সময়ে বিতর্কে দেখেছি, এই আর্যাবর্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তথাকথিত ডানপন্থী হিন্দুরা হয় অস্বস্তিতে পড়েন, নয়তো এড়িয়ে যান। স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না। দেখুন, শাস্ত্রে আর্যবর্তের তিন প্রকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমি একে একে বলছি: ১.মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাইশতম শ্লোকটি দেখুন।এই শ্লোক অনুযায়ী, আজকের পুরো ভারতই আর্যাবর্ত। শুধু তাই নয়, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রের (1.9) প্রথম অধ্যায়ে মনুস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে হিমালয়ের দক্ষিণ পর্যন্ত আর্যাবর্ত প্রসারিত।(বাংলা হিমালয়ের দক...